ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিবেদক o
`নিজের জমিতে নিজে বাড়ি। তাও সেমি পাকা বাড়ি। এটা ছিল আমাদের কাছে দিবাস্বপ্ন। বর্ষা মৌসুমে ঝড়-বৃষ্টিতে ভেজা, শীতের কনকনে ঠান্ডায় জীর্নশীর্ন। লোকজন চলে গেলে রেলওয়ে স্টেশন, রেললাইনের ঢালে পলিথিন টাঙ্গানো। তারপর পরিজনদের নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমানো। আবার কাক ডাকা ভোরেই জনতার কোলাহলে উঠে পড়া। গৃহহীন থাকায় কতই না করেছি কষ্ট। জমি না থাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করাটা ছিলো স্বপ্নের মতো। সৃষ্টি কর্তার নিকট কতই যে করেছি প্রার্থনা। সৃষ্টি কর্থা সেই প্রার্থনা কবুল করেছেন। শেখের বেটি শেখ হাসিনা আমাদের সেই কষ্ট দুর করেছেন। দিলেন সেমি পাকা বাড়ি। যা আমাদের নিকট স্বপ্নের মতো।’ এভাবেই নিজেদের অনুভূতির কথা জানালেন বাড়ি পাওয়া প্রতিবন্ধী আলমগীর হোসেন, বয়োবৃদ্ধ সুকজান বেওয়া, জুলেখা বেগম, দেলোয়ার প্রামানিক প্রমূখ।
এরা সবাই ঈশ্বরদীর বিভিন্ন এলাকায় অন্যের জমিতে, রেলওয়ের লাইনের ঢালে, স্কুল কলেজ কিংবা অন্যের বাড়ির বারান্দায় বসবাসকারী সুবিধা বঞ্চিত ও আশ্রয়হীন মানুষ। এদের মতো প্রথম ধাপে বাড়ি পাবেন ৫০ পরিবার। আধাপাকা নতুন বাড়ি পাওয়া এসব ভূমি ও গৃহহীন পরিবারের মানুষগুলো এখন গভীর স্বপ্নে বিভোর।
আজ শনিবার (২৩ জানুয়ারি) সকালে ঈশ্বরদীসহ সারাদেশে একযোগে গণভবন থেকে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারদের নতুন বাড়ি হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের ঢুলটি আশ্রয়ন প্রকল্প, সাঁড়া ইউনিয়নের সাঁড়া ব্লকহাট ও লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়নের কামালপুর আশ্রয়ন প্রকল্প ঘুরে দেখা ও নির্মাণকাজের মিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুইশত জমির উপর সাড়ে ১৯ ফিট লম্বা ও সাড়ে ২১ ফিট চওড়া জায়গায় মধ্যে দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি শোয়ার ঘর, একটি রান্নাঘর, একটি টয়লেট এবং বাইরে বারান্দা রেখে সেমিপাকা বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। বাড়িতে লাগানো হয়েছে রঙ্গিন টিন। লাগানো হয়েছে টিনের জানালা ও দরজা। রঙ করা হয়েছে পুরো বাড়ি। দুই বাড়ি মিলিয়ে পানির ব্যবস্থা করতে বসানো হয়েছে একটি একটি করে টিউওবয়েল।
মিস্ত্রিরা বলেন, এই বাড়ি করতে প্রতিটির জন্য কমপক্ষে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার প্রয়োজন। সরকারি বাজেটই এসেছে অর্ধেক। বাজেট বেশ হলে বাড়িগুলো আরো মানসম্মত করে নির্মাণ করা যেতো বলে দাবী করেন।
প্রতিবন্ধী আলমগীর হোসেন বলেন, জন্মগতভাবেই তিনি পঙ্গু। রিক্সা চালাতে পারেন না। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঈশ্বরদীর পাতিবিল এলাকায় রেললাইনের ঢালে পলিথিন টাঙ্গিয়ে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকেন। সারাদিন বাইরে কাজ করার চেষ্টা করেন। সংসার চলে না। তাই স্ত্রী করেন পরের বাড়িতে কাজ। কাজ শেষ করে ফিরেন ওই ঝুপড়িতে। নিজের নামে জমি ও আধাপাকা ঘর হবে সেটা কখনোই স্বপ্নেই দেখিনি। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের জমি-বাড়ি দিয়েছেন। আমরা এখন নিজের বাড়িতে থাকবো। প্রধানমন্ত্রীর জন্য সর্বদা দোয়া করবো।
ভূমি ও গৃহহীন হতদরিদ্র সুকজান বেগম নতুন বাড়ি ও জমি পেয়ে চোখে ছলছলে পানি নিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে কালের কন্ঠকে বলেন, শহরের দড়িনারিচা পশ্চিম টেংরী এলাকার পরের জায়গায় কুঁড়ে ঘর বানিয়ে ছেলে, নাতি ও বোনকে নিয়ে থাকেন। স্বপ্নেও ভাবিনী কখনো নিজের নামে পাকা ঘর হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা আমাকে ইটের একটি ঘর দিয়েছেন। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। দোয়া করি শেখ হাসিনা দীর্ঘকাল বেঁচে থাকুন।
ভুমি ও গৃহহীর হতদরিদ্র জুলেখা বেগম আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, বাড়ি পেয়ে আমি যে কত খুশি হয়েছি তা মুখে বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের দীর্ঘদিনের থাকার কষ্ট দুর হলো। এখন নিশ্চিন্তে নিজের জায়গায় থাকতে পারবো। আমি সর্বদা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবার পরিজনের জন্য আল্লাহ নিকট দোয়া করবো।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোঃ তৌহিদুল ইসলাম কালের কন্ঠকে বলেন, মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ভূমি ও গৃহহীন পরিবারদের বিনা টাকায় ঘর উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সারাদেশের ন্যায় ঈশ্বরদীতেও আশ্রয়ণ প্রকল্পের -২ আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারদের মাঝে নতুন ঘর উপহার দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঈশ্বরদীতে প্রতিটি ঘরের জন্য দুই শতাংশ খাসজমি বন্দোবস্তসহ দুই কক্ষের সেমিপাকা বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি বাড়িতে একটি রান্না ঘর, টয়লেট ও সামনে খোলা বারান্দা রয়েছে। এই উপজেলার জন্য স¤প্রতি পাবনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মাধ্যমে ‘ক’ ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত ভূমিহীন ও গৃহহীন ১৯৬টি পরিবারের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রথম পর্যায়ে ঈশ্বরদী উপজেলায় ৫০টি পরিবারকে জমি ও ঘর নির্মাণ করে দিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মুলাডুলি ইউনিয়নে ৩৩ লক্ষীকুন্ডায় ১০ এবং সাঁড়া ইউনিয়নে রয়েছে ৭টি ঘর। মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৫ লাখ ৫০ হাজার এবং প্রতিটি গৃহনির্মাণে ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পিএম ইমরুল কায়েস বলেন, মনোরম পরিবেশে মানসম্মত টেকসই করে এসব ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। যেসব ভূমিহীন দরিদ্র মানুষ রাস্তার ধারে ফুটপাত বা অন্যের আশ্রয়ে বসবাস করতেন তাদেরকেই প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর উপহার দেওয়া হয়েছে। এর ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। ইউএনও আরোও বলেন, পর্যায়ক্রমে উপজেলার শতভাগ দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাদের জমি ও ঘর নেই, তাদের বসবাসের জন্য বাড়ি দেওয়া হবে।
বাংলার কথা/শেখ মেহেদী হাসান/জানুয়ারি ২৩, ২০২১